Menu |||

সকল পিতা-মাতা আপনজনঃ ফারহানা মোবিন

মাধবী রহমানের জীবনটা নুয়ে পড়া পাতাবাহারের মতো, যার শেকড় আছে অথচ দুর্বল শাখা-প্রশাখার জন্য শক্ত হয়ে বাড়তে পারে না। অশীতিপর মাধবী রহমানও দুর্বল দেহের জন্য সোজাভাবে দাঁড়াতে পারেন না। বাঁকা হয়ে গেছে মেরুদন্ডের হাড়। একাকিত্বের বোঝা তাঁর দুই কাঁধে। প্রতিমুহূর্তে প্রতীক্ষা করেন – এই বুঝি মৃত্যু কড়া নাড়ল জীবনের দুয়ারে। মাঝবয়সী বুয়া মাধবীর জীবনসঙ্গী। তাঁর বিশাল বাড়টিতে জীবনের সব আয়োজন নিথর হয়ে গেছে মানুষের অভাবে। স্বামী ওপারের বাসিন্দা হয়েছেন ৩৭ বছর আগে। একমাত্র ছেলেটি আমেরিকায় গড়েছে ঘরবসতি। ছেলে, নাতি-নাতনির ¯েœহপরশ তাঁর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে। তাই আমেরিকার বাসিন্দা হননি তিনি। মনটা তাঁর লুকোচুরি খেলে একমাত্র মেয়ের প্রতি। মনের প্রতিটি পথঘাটে স্বপ্ন জাগে মেয়ের বাসায় থাকার। কিন্তু লোকচক্ষুর ভয় আর আত্মসম্মানবোধ তৈরি করে বাধার দেয়াল। ঘরজামাই রাখতে পারেন না, আমার মেয়ের বাসায়ও যান না। মেয়ের স্বামীর বাসায় এক সপ্তাহ থাকলেই অস্বস্তির পাহাড় উঁচু হয়ে দাঁড়ায়। নিজের বাসায় ফেরার সময় মনটা মানতেই চায় না। জীবনের শেষ দিনগুলো মেয়ের সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছে হয়। অপরদিকে মেয়েও উপলব্ধি করেন মায়ের এই অনুভূতি। অথচ মাকে বলতে পারেন না তাঁর পরিবারের সদস্য হওয়ার জন্য। সমাজে সমালোচনার টর্নেডো বয়ে যাবে – এমন আশঙ্কায় মনটা ভরে ওঠে। অথচ বৃদ্ধ মায়ের একাকিত্বের নীল বেদনা তাঁকে প্রতিনিয়ত দেয় ধিক্কার, অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো ঝরতে থাকে নীরব অশ্রু হয়ে।

আমাদের দেশে এমন অগণিত মাধবী রহমান রয়েছেন, যাঁরা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে গোনেন বন্দীত্বের প্রহর, একাকিত্বের বেড়াজাল। লোকচক্ষুর ভয় আর সামাজিক রীতির জন্য থাকতে পারেন না মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। প্রিয় পাঠক, আজ আমরা উপলব্ধি করব এমন কিছু মাধবী রহমানদের অসহায়ত্ব।

কেস স্টাডি-১
ধানমন্ডি নিবাসী আসমা হক (ছদ্ম নাম) তাঁর দিন কাটান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে। চারটি মেয়েই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে বলতে গেলে দেখাই হয় না। চিকিৎস পুত্রবধূ রোগী সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু গৃহকোণের নির্ভতে পড়ে থাকা শাশুড়ির সেবায় নেই তার সময় আর উদ্দীপনা। নাতনি পড়তে গেছে দেশের বাইরে। বাসায় বুয়া, মালিও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমার কাচটা মুছতে থাকেন আর হতাশার স্বরে বলেন, ‘সরাক্ষণ আমার মন খারাপ লাগে। খুব ইচ্ছে করে আমার মেয়ের বাসায় নাতনিদের সঙ্গে থাকতে, নানুভাইদের সঙ্গে খেলতে। বই পড়তে আর ভালো লাগে না, ওষুধ খেতেও ইচ্ছে হয় না। কিন্তু মেয়ের বাসায় তো থাকা যাবে না। জামাই বিরক্ত হবে। জামাইবাড়িতে তাঁর মা কে মানায়, আমাকে না।’

আসমা হক নাতনিদের অ্যালবামের ওপর বুলাতে থাকেন আঙ্গুলের স্পর্শ। হতাশার বিন্দুগুলো চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে ছবির অ্যালবামে। ছবিগুলো হয়ে যায় ঝাপসা।

কেস স্টাডি-২
রায়েরবাজারনিবাসী মৃদুলা (ছদ্ম নাম) বলেন, ‘২০ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার ভাই চাকরি করেন টেকনাফে। দূরত্বের জন্য নিয়মিত ঢাকায় আসতে আসতে পারেন না। ১২ বছর ধরে আমার বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তাঁকে দেখাশোনা করেন আমার বৃদ্ধ মা। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং এক চোখে ছানি। ছোট্ট একটা কাজের মেয়ে, মা আর বাবা ছোট একটা বাড়িতে কেরাণীগঞ্জে থাকেন। বাবা বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, সারাদিন শুয়ে থাকেন। প্রায় রাতে মা বাবার পাশে বসে থাকেন জীর্ণ বেতের চেয়ারে। মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েন। তখন তাঁর সারা দেহে জড়িয়ে থাকে অজ¯্র মশা। মা-বাবাকে আমার স্বামীর বাসায় রাখার মতো আর্থিক সংগতি থাকলেও, নেই স্বামী-শাশুড়ির ইচ্ছা। অথচ আমার শাশুড়ি অসুস্থ হলে আমি কখনোই তাঁকে অবহেলা করতাম না। একমাত্র ভাই-ভাবিও মা-বাবার প্রতি ভীষণ উদাসীন। তাঁদের এই দুর্দিনে সন্তান হয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না। এ পরিস্থিতি যে কতটা যন্তণাদায়ক তা বোঝানোর নয়।’

চমশার কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা যেতে থাকে মৃদুলার চোখের ভেজা পাপড়ি। আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘নিজের ঘরের বদনাম কেউ গায় না, অনেক কষ্টে কথাগুলো বের হয়ে গেল।’

কেস স্টাডি – ৩
একমাত্র মেয়ে এখন স্বামীর বাড়িতে। বিশাল ফাঁকা বাড়িটা নীলিমা খানকে (ছদ্মনাম) গলা চেপে ধরছিল। তাই এক বছর যাবৎ তিনি রয়েছেন তাঁর মেয়ের জামাইয়ের বাসায়। একা হওয়ার জন্য তিনি নিজের বাসায় থাকতে পারেন না অথচ প্রতিমুহূর্তে তাঁর বুকে বিধতে থাকে অপরাধবোধের কাঁটা। স্বামীর কথা মনে করে বৃদ্ধ নীলিমা খান বলেন, ‘কেন যে মানুষটা এত দ্রুত চলে গেল (মারা গেছেন)! বেঁচে থাকলে জামাইয়ের বাসায় থাকতে হতো না। জামাই আমাকে নিজের মায়ের মতোই দেখে। আমাকে স্থায়ীভাবে তাঁর বাসাতেই থেকে যেত বলে, কিন্তু প্রতিবেশী আর জামাইয়ের আত্মীয়স্বজনের কটূক্তি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। তাঁদের বক্তব্য – আমি জামাইয়ের বেতনবিহীন গভর্নেস।’

আমাদের সমাজের ধারণা, বিয়ে হওয়া মেয়েরা পরের মূলধন। আর জামাই অতি আদরের পাত্র কিন্তু পরের ছেলে। জামাইয়ের বাসায় তাঁর মা-বাবাকে মানায়, মেয়ের মা-বাবাকে নয়। মেয়ের বাসায় বেড়ানো যায় কিন্তু জামাইয়ের মুখাপেক্ষী হওয়াটা লজ্জার। জামাইয়ের বাসায় থাকার চেয়ে নিজের বাসায় মরে যাওয়া ভালো। আমাদের চারপাশের অসংখ্য মানুষ এমন ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। বাসায় স্বামীর মা-বাবা আমাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষ। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে তিল তিল করে তাঁরা সন্তানদের বড় করেন। বিয়ের পর একজন পুরুষ হয়ে যায় তাঁর স্ত্রীর পরম আত্মীয়। তাই স্ত্রীর মা-বাবা মানে স্বামীরই আপনজন।

এ বিষয়ে নারী বিশিষ্ট নারী নেত্রী শিরিন হক বলেন, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের বিয়ের পর বৃদ্ধ মা-বাবা বিশেষত বিধমা মা এবং যেসব মায়ের ছেলে নেই বা ছেলে দূরে রয়েছেন, তাঁরা কষ্টের শিকার হন বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নারী-পুরুষের উচিত শ্বশুড়-শাশুড়িকে নিজের মা-বাবার স্থানটা দেওয়া। স্বামীর মা-বাবার প্রতি স্ত্রীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি স্ত্রীর মা-বাবার প্রতিও রয়েছে স্বামীর সমান দায়িত্ব। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি যদি একাকী জীবন যাপন করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে রাখা, সাধ্যমতো সময় দেওয়া প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। সংসারটা নারী-পুরুষ দুজনের। আর প্রতিটি মুহূর্তের সুখ-দুঃখের সমান অংশীদারও তাঁরা দুজন। তাই একজনের মা- বাবা অপরের আপনজন। আমাদের প্রত্যেকের চিন্তা করা উচিত, একদিন আমরাও বৃদ্ধ হব। সন্তানদের অবহেলা আমাদের জন্য হবে মারাত্মক বেদনাদায়ক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ মূল্যবোধটা থাকলে সন্তানদের মধ্যেও তা গড়ে উঠবে। ফলে আগামী প্রজন্মের মধ্যে বাড়বে পরিবারের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ হয়ে যায় অসহায়। দেহের রক্ত-মাংসের গাঁথুনি দুর্বল হতে থাকে। এ সময় মানুষের প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসা, সর্বোপরি মানসিক সহযোগিতা। বয়স বাড়ার কারণে বিভিন্ন রোগের উপদ্রবও বাড়তে থাকে। এ সময় একাকিত্ব ও পরিবার-পরিজনের অবহেলা তাঁদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। পরিণতিতে দৈহিক রোগের সঙ্গে মানসিক রোগের মাত্রাও যোগ হয়, যা কখানোই কম্য নয়। সবকিছুর উর্ধ্বে আমাদের প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো।

এ বিষয়ে শিরীন হকের মতে, মন ও মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য করণীয় ঃ
গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে এ সমস্যা আরও বেশি প্রকট। এ জন্য সরকারকে কর্মমুখী শিক্ষার হার বাড়াতে হবে।
সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা অপরিহার্য।
প্রতিটি নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
নারী সংগঠনগুলোর আরও বেশি কর্মতৎপর হওয়া উচিত।
প্রতিটি পরিবারের মা-বাবার উচিত, সন্তানদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। পাঠ্যসূচিতে মানবিক মূল্যবোধসংবলিত পড়া সংযোজন করা দরকার।
প্রতিটি নারীকে পুরুষের সমপর্যায়ে মূল্যায়ন করা জরুরি।
ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর আশা আকাঙ্খাগুলো তুলে ধরা। এতে পরস্পরের চিন্তাচেতনা পরিস্কার হবে।
বুড়ো বয়সে ছেলেরাই মা-বাবাকে দেখে, আর মেয়েরা পরের বাসায় চলে যায়, তাই নারীদের ওপর নির্ভর করাটা অর্থহীন – এ মনোভাব দূর করার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অতীব জরুরী।

আমরা কোনো বৃদ্ধ মা-বাবার চোখের নিচে ধূসর কালি দেখতে চাই না। বার্ধক্যের কুঁচকে যাওয়া ত্বকে ভরে উঠুক প্রশান্তির স্পর্শ। প্রতিটি নারী-পুরুষের মমতার দৃষ্টি পড়–ক মা-বাবার প্রতি। তা না হলে বাড়তে থাকবে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা। আমাদের বৃদ্ধাশ্রম চাইনা। প্রতিটি সন্তানের মমতার দৃষ্টি পড়–ক তার পিতা-মাতার প্রতি। আমরা যদি ভালো কাজ করতে পারি, তাহলে আমাদের দেখে অনপ্রাণিত হবে পরবর্তী প্রজন্ম।

 

ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস (ডি.ইউ), পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (পাবলিক হেল্থ),
পিজিটি (গাইনী এন্ড অবস্-স্কয়ার হাসপাতাল),
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (গাইনী এন্ড অবস্),
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ,
ডায়াবেটোলোজি, বারডেম হসপিটাল (অনগোয়িং)
উপস্থাপিকাঃ ‘প্রবাসীর ডাক্তার’ বাংলাটিভিতে প্রচারিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান
সম্পাদকঃ (কুয়েত বাংলা নিউজ ডটকম) www.kuwaitbanglanews.com
স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদকঃ অগ্রদৃষ্টি নিউজ পোর্টাল

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» তারেক মনোয়ার একজন স্পষ্ট মিথ্যাবাদী

» কুয়েতে নতুন আইনে অবৈধ প্রবাসীদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে

» সোশ্যাল প্লাটফর্মে লন্ডনী মেয়েদের বেলেল্লাপনা,চাম্পাবাত সবার শীর্ষে

» ফারুকীর পদত্যাগের বিষয়টি সঠিক নয়

» পাকিস্তান থেকে সেই আলোচিত জাহাজে যা যা এল

» মিছিল করায় আট মাস ধরে সৌদি কারাগারে ৯৩ প্রবাসী, দুশ্চিন্তায় পরিবার

» কুয়েতে যুবলীগের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

» ক্ষমা না চাইলে নুরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়

» বাকু থেকে ফিরলেন ড. মুহাম্মাদ ইউনূস

» শুক্রবার আহত ও শহীদদের স্মরণে কর্মসূচি দিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

সকল পিতা-মাতা আপনজনঃ ফারহানা মোবিন

মাধবী রহমানের জীবনটা নুয়ে পড়া পাতাবাহারের মতো, যার শেকড় আছে অথচ দুর্বল শাখা-প্রশাখার জন্য শক্ত হয়ে বাড়তে পারে না। অশীতিপর মাধবী রহমানও দুর্বল দেহের জন্য সোজাভাবে দাঁড়াতে পারেন না। বাঁকা হয়ে গেছে মেরুদন্ডের হাড়। একাকিত্বের বোঝা তাঁর দুই কাঁধে। প্রতিমুহূর্তে প্রতীক্ষা করেন – এই বুঝি মৃত্যু কড়া নাড়ল জীবনের দুয়ারে। মাঝবয়সী বুয়া মাধবীর জীবনসঙ্গী। তাঁর বিশাল বাড়টিতে জীবনের সব আয়োজন নিথর হয়ে গেছে মানুষের অভাবে। স্বামী ওপারের বাসিন্দা হয়েছেন ৩৭ বছর আগে। একমাত্র ছেলেটি আমেরিকায় গড়েছে ঘরবসতি। ছেলে, নাতি-নাতনির ¯েœহপরশ তাঁর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে। তাই আমেরিকার বাসিন্দা হননি তিনি। মনটা তাঁর লুকোচুরি খেলে একমাত্র মেয়ের প্রতি। মনের প্রতিটি পথঘাটে স্বপ্ন জাগে মেয়ের বাসায় থাকার। কিন্তু লোকচক্ষুর ভয় আর আত্মসম্মানবোধ তৈরি করে বাধার দেয়াল। ঘরজামাই রাখতে পারেন না, আমার মেয়ের বাসায়ও যান না। মেয়ের স্বামীর বাসায় এক সপ্তাহ থাকলেই অস্বস্তির পাহাড় উঁচু হয়ে দাঁড়ায়। নিজের বাসায় ফেরার সময় মনটা মানতেই চায় না। জীবনের শেষ দিনগুলো মেয়ের সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছে হয়। অপরদিকে মেয়েও উপলব্ধি করেন মায়ের এই অনুভূতি। অথচ মাকে বলতে পারেন না তাঁর পরিবারের সদস্য হওয়ার জন্য। সমাজে সমালোচনার টর্নেডো বয়ে যাবে – এমন আশঙ্কায় মনটা ভরে ওঠে। অথচ বৃদ্ধ মায়ের একাকিত্বের নীল বেদনা তাঁকে প্রতিনিয়ত দেয় ধিক্কার, অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো ঝরতে থাকে নীরব অশ্রু হয়ে।

আমাদের দেশে এমন অগণিত মাধবী রহমান রয়েছেন, যাঁরা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে গোনেন বন্দীত্বের প্রহর, একাকিত্বের বেড়াজাল। লোকচক্ষুর ভয় আর সামাজিক রীতির জন্য থাকতে পারেন না মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। প্রিয় পাঠক, আজ আমরা উপলব্ধি করব এমন কিছু মাধবী রহমানদের অসহায়ত্ব।

কেস স্টাডি-১
ধানমন্ডি নিবাসী আসমা হক (ছদ্ম নাম) তাঁর দিন কাটান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে। চারটি মেয়েই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে বলতে গেলে দেখাই হয় না। চিকিৎস পুত্রবধূ রোগী সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু গৃহকোণের নির্ভতে পড়ে থাকা শাশুড়ির সেবায় নেই তার সময় আর উদ্দীপনা। নাতনি পড়তে গেছে দেশের বাইরে। বাসায় বুয়া, মালিও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমার কাচটা মুছতে থাকেন আর হতাশার স্বরে বলেন, ‘সরাক্ষণ আমার মন খারাপ লাগে। খুব ইচ্ছে করে আমার মেয়ের বাসায় নাতনিদের সঙ্গে থাকতে, নানুভাইদের সঙ্গে খেলতে। বই পড়তে আর ভালো লাগে না, ওষুধ খেতেও ইচ্ছে হয় না। কিন্তু মেয়ের বাসায় তো থাকা যাবে না। জামাই বিরক্ত হবে। জামাইবাড়িতে তাঁর মা কে মানায়, আমাকে না।’

আসমা হক নাতনিদের অ্যালবামের ওপর বুলাতে থাকেন আঙ্গুলের স্পর্শ। হতাশার বিন্দুগুলো চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে ছবির অ্যালবামে। ছবিগুলো হয়ে যায় ঝাপসা।

কেস স্টাডি-২
রায়েরবাজারনিবাসী মৃদুলা (ছদ্ম নাম) বলেন, ‘২০ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার ভাই চাকরি করেন টেকনাফে। দূরত্বের জন্য নিয়মিত ঢাকায় আসতে আসতে পারেন না। ১২ বছর ধরে আমার বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তাঁকে দেখাশোনা করেন আমার বৃদ্ধ মা। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং এক চোখে ছানি। ছোট্ট একটা কাজের মেয়ে, মা আর বাবা ছোট একটা বাড়িতে কেরাণীগঞ্জে থাকেন। বাবা বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, সারাদিন শুয়ে থাকেন। প্রায় রাতে মা বাবার পাশে বসে থাকেন জীর্ণ বেতের চেয়ারে। মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েন। তখন তাঁর সারা দেহে জড়িয়ে থাকে অজ¯্র মশা। মা-বাবাকে আমার স্বামীর বাসায় রাখার মতো আর্থিক সংগতি থাকলেও, নেই স্বামী-শাশুড়ির ইচ্ছা। অথচ আমার শাশুড়ি অসুস্থ হলে আমি কখনোই তাঁকে অবহেলা করতাম না। একমাত্র ভাই-ভাবিও মা-বাবার প্রতি ভীষণ উদাসীন। তাঁদের এই দুর্দিনে সন্তান হয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না। এ পরিস্থিতি যে কতটা যন্তণাদায়ক তা বোঝানোর নয়।’

চমশার কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা যেতে থাকে মৃদুলার চোখের ভেজা পাপড়ি। আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘নিজের ঘরের বদনাম কেউ গায় না, অনেক কষ্টে কথাগুলো বের হয়ে গেল।’

কেস স্টাডি – ৩
একমাত্র মেয়ে এখন স্বামীর বাড়িতে। বিশাল ফাঁকা বাড়িটা নীলিমা খানকে (ছদ্মনাম) গলা চেপে ধরছিল। তাই এক বছর যাবৎ তিনি রয়েছেন তাঁর মেয়ের জামাইয়ের বাসায়। একা হওয়ার জন্য তিনি নিজের বাসায় থাকতে পারেন না অথচ প্রতিমুহূর্তে তাঁর বুকে বিধতে থাকে অপরাধবোধের কাঁটা। স্বামীর কথা মনে করে বৃদ্ধ নীলিমা খান বলেন, ‘কেন যে মানুষটা এত দ্রুত চলে গেল (মারা গেছেন)! বেঁচে থাকলে জামাইয়ের বাসায় থাকতে হতো না। জামাই আমাকে নিজের মায়ের মতোই দেখে। আমাকে স্থায়ীভাবে তাঁর বাসাতেই থেকে যেত বলে, কিন্তু প্রতিবেশী আর জামাইয়ের আত্মীয়স্বজনের কটূক্তি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। তাঁদের বক্তব্য – আমি জামাইয়ের বেতনবিহীন গভর্নেস।’

আমাদের সমাজের ধারণা, বিয়ে হওয়া মেয়েরা পরের মূলধন। আর জামাই অতি আদরের পাত্র কিন্তু পরের ছেলে। জামাইয়ের বাসায় তাঁর মা-বাবাকে মানায়, মেয়ের মা-বাবাকে নয়। মেয়ের বাসায় বেড়ানো যায় কিন্তু জামাইয়ের মুখাপেক্ষী হওয়াটা লজ্জার। জামাইয়ের বাসায় থাকার চেয়ে নিজের বাসায় মরে যাওয়া ভালো। আমাদের চারপাশের অসংখ্য মানুষ এমন ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। বাসায় স্বামীর মা-বাবা আমাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষ। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে তিল তিল করে তাঁরা সন্তানদের বড় করেন। বিয়ের পর একজন পুরুষ হয়ে যায় তাঁর স্ত্রীর পরম আত্মীয়। তাই স্ত্রীর মা-বাবা মানে স্বামীরই আপনজন।

এ বিষয়ে নারী বিশিষ্ট নারী নেত্রী শিরিন হক বলেন, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের বিয়ের পর বৃদ্ধ মা-বাবা বিশেষত বিধমা মা এবং যেসব মায়ের ছেলে নেই বা ছেলে দূরে রয়েছেন, তাঁরা কষ্টের শিকার হন বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নারী-পুরুষের উচিত শ্বশুড়-শাশুড়িকে নিজের মা-বাবার স্থানটা দেওয়া। স্বামীর মা-বাবার প্রতি স্ত্রীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি স্ত্রীর মা-বাবার প্রতিও রয়েছে স্বামীর সমান দায়িত্ব। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি যদি একাকী জীবন যাপন করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে রাখা, সাধ্যমতো সময় দেওয়া প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। সংসারটা নারী-পুরুষ দুজনের। আর প্রতিটি মুহূর্তের সুখ-দুঃখের সমান অংশীদারও তাঁরা দুজন। তাই একজনের মা- বাবা অপরের আপনজন। আমাদের প্রত্যেকের চিন্তা করা উচিত, একদিন আমরাও বৃদ্ধ হব। সন্তানদের অবহেলা আমাদের জন্য হবে মারাত্মক বেদনাদায়ক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ মূল্যবোধটা থাকলে সন্তানদের মধ্যেও তা গড়ে উঠবে। ফলে আগামী প্রজন্মের মধ্যে বাড়বে পরিবারের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ হয়ে যায় অসহায়। দেহের রক্ত-মাংসের গাঁথুনি দুর্বল হতে থাকে। এ সময় মানুষের প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসা, সর্বোপরি মানসিক সহযোগিতা। বয়স বাড়ার কারণে বিভিন্ন রোগের উপদ্রবও বাড়তে থাকে। এ সময় একাকিত্ব ও পরিবার-পরিজনের অবহেলা তাঁদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। পরিণতিতে দৈহিক রোগের সঙ্গে মানসিক রোগের মাত্রাও যোগ হয়, যা কখানোই কম্য নয়। সবকিছুর উর্ধ্বে আমাদের প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো।

এ বিষয়ে শিরীন হকের মতে, মন ও মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য করণীয় ঃ
গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে এ সমস্যা আরও বেশি প্রকট। এ জন্য সরকারকে কর্মমুখী শিক্ষার হার বাড়াতে হবে।
সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা অপরিহার্য।
প্রতিটি নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
নারী সংগঠনগুলোর আরও বেশি কর্মতৎপর হওয়া উচিত।
প্রতিটি পরিবারের মা-বাবার উচিত, সন্তানদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। পাঠ্যসূচিতে মানবিক মূল্যবোধসংবলিত পড়া সংযোজন করা দরকার।
প্রতিটি নারীকে পুরুষের সমপর্যায়ে মূল্যায়ন করা জরুরি।
ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর আশা আকাঙ্খাগুলো তুলে ধরা। এতে পরস্পরের চিন্তাচেতনা পরিস্কার হবে।
বুড়ো বয়সে ছেলেরাই মা-বাবাকে দেখে, আর মেয়েরা পরের বাসায় চলে যায়, তাই নারীদের ওপর নির্ভর করাটা অর্থহীন – এ মনোভাব দূর করার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অতীব জরুরী।

আমরা কোনো বৃদ্ধ মা-বাবার চোখের নিচে ধূসর কালি দেখতে চাই না। বার্ধক্যের কুঁচকে যাওয়া ত্বকে ভরে উঠুক প্রশান্তির স্পর্শ। প্রতিটি নারী-পুরুষের মমতার দৃষ্টি পড়–ক মা-বাবার প্রতি। তা না হলে বাড়তে থাকবে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা। আমাদের বৃদ্ধাশ্রম চাইনা। প্রতিটি সন্তানের মমতার দৃষ্টি পড়–ক তার পিতা-মাতার প্রতি। আমরা যদি ভালো কাজ করতে পারি, তাহলে আমাদের দেখে অনপ্রাণিত হবে পরবর্তী প্রজন্ম।

 

ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস (ডি.ইউ), পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (পাবলিক হেল্থ),
পিজিটি (গাইনী এন্ড অবস্-স্কয়ার হাসপাতাল),
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (গাইনী এন্ড অবস্),
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ,
ডায়াবেটোলোজি, বারডেম হসপিটাল (অনগোয়িং)
উপস্থাপিকাঃ ‘প্রবাসীর ডাক্তার’ বাংলাটিভিতে প্রচারিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান
সম্পাদকঃ (কুয়েত বাংলা নিউজ ডটকম) www.kuwaitbanglanews.com
স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদকঃ অগ্রদৃষ্টি নিউজ পোর্টাল

Facebook Comments Box


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Thu, 21 Nov.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।